বৃহস্পতিবার, ৩১ মে, ২০১২

এই ধরিত্রী আমাদেরই অংশ



আ লী  ই মা ম
চরম অবিবেচক হিসেবে রোম সম্রাট নিরোর পরিচিতি ছিল। তার খামখেয়ালিপনাজাত স্বভাব এবং ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ নিয়ে প্রচুর কাহিনী প্রচলিত আছে। অন্যজনের প্রতি পীড়াদায়ক ব্যবহার করে বিকৃত মানসিকতার তৃপ্তি পেতেন তিনি। মনোবিদদের ধারণা তিনি একজন মর্ষকামী ছিলেন। তার উদ্ভট আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টি হয়েছিল সেই বহুল প্রচারিত উক্তিটি, ‘রোম নগরী যখন পুড়ছে সম্রাট নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলেন।’
কথাটি নতুন করে মনে এল যখন অসহায়ের মতো আমাদের বসবাসের স্থান বিপন্ন গ্রহটিকে প্রত্যক্ষ করছি। সাম্প্রতিক সময়ের বিবিধ ঘটনাবলি বিশ্লেষণ করে এই চিন্তার উদ্রেক হয়েছে। পৃথিবী নামের গ্রহটি যখন প্রচণ্ড তাপদাহে রীতিমতো পুড়ছে তখন জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে কতিপয় নীতিনির্ধারক-দেশের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠেছে। কূটকৌশলে চিহ্নিত সমস্যাগুলোর সমাধানের উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সমস্যা সৃষ্টিকারী উন্নত দেশগুলো যেন নিরোর মতোই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিচ্ছে। কার্বন নিঃসরণে ও গ্রিনহাউস গ্যাসের জন্য ওজোন স্তরে গর্ত হওয়াতে যে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার সমাধানের জন্য কার্বন (সিএফসি) নিঃসরণের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণ করার কার্যকর পদক্ষেপ গৃহীত হচ্ছে না। গ্রহটিকে বাঁচানোর জন্য ঐকমত্যেও আসা সম্ভবপর হচ্ছে না। সুকৌশলে সমস্যাটিকে অনেকটা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমাদের গ্রহের এই মারাত্মক বিপর্যয় যেহেতু তাদের যাপিত জীবনযাত্রাকে ততটা ক্ষতিগ্রস্ত করছে না তাই তারা নিস্পৃহতার পরিচয় দিচ্ছে। যেন তাপের আঁচ তাদের গায়ে লাগছে না। আবহাওয়া বৈরী আচরণ করছে। অসহনীয় এক পরিবেশে আমরা প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছি। পরিবেশবিদদের মতে, যদি দ্রুত দেশে পরিবেশবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টি করা না-যায় তা হলে আমাদের দেশ বসবাসের জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বে। এই গ্রীষ্ম তীব্র তাপদাহে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রতিবছর ০.০০৩৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস করে তাপমাত্রা বেড়ে চলেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলোয় প্রায়ই তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠছে। এ প্রবণতা আগামী দিনগুলোতে আরও বৃদ্ধি পাবে বলে আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। আমাদের দেশটি পরিচিত ছিল নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার দেশ বলে। কিন্তু প্রেক্ষাপট এখন পালটে গেছে। বিশ্বাসের পরিবর্তন হয়েছে। বিগত কয়েক বছরের তাপমাত্রার অস্বাভাবিক আচরণ সেই পরিচিতিকে ম্লান করে দিয়েছে। ১৯৬০ সালে আমাদের দেশে সর্বোচ্চ ৪২.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা নথিভুক্ত করা হয়েছিল। ১৯৭২ সালে ৪৫ দশমিক ১ এবং নব্বইয়ের দশকে নথিভুক্ত হয় ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা অত্যধিক বেশি।
আমরা বর্তমান সময়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধিজনিত কারণে যে ভয়াবহ সমস্যায় আক্রান্ত হয়েছি তাতে আবহাওয়াবিদদের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। যে পরিবেশ ব্যবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণ করছে তার প্রেক্ষাপট আবিষ্কার করতে আগ্রহী হয়ে উঠেছি আমরা। জানা গেছে, গত ৫০ বছরে দেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দশমিক ৫ শতাংশ। এমনকি ২০৫০ সালে বাংলাদেশের তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২১০০ সাল নাগাদ এই হিসাবে ২ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আবহাওয়াবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন যে এই বাড়তি তাপমাত্রায় পানির বাষ্পীভবন বেড়ে যাবে এবং বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়িয়ে দেবে। আর্দ্র বাতাসের প্রভাবে তাপমাত্রা বেড়ে যাবে। বাংলাদেশের আর্দ্রতার মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণ মানুষ তথ্য-উপাত্তের এই হিসাব-নিকাশ না জানলেও এটুকু বুঝতে সক্ষম যে জীবনপ্রবাহ বিপর্যস্ত হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে আমাদের দেশটি।
আমাদের এ পৃথিবীটা হল একটি সবুজ ঘর এবং কার্বন-ডাই-অক্সাইডের স্তর ঘরের চারপাশের একটি কাচের দেয়াল। সূর্যের যেসব রশ্মি এ কাচের দেয়াল ভেদ করে পৃথিবীর উপরিভাগকে উত্তপ্ত করে, এ স্তর বা কাচের দেয়াল সেই তাপকে বাইরে বেরিয়ে যেতে বাধা দেয়। এর পরিমাণ বা ঘনত্ব যত বৃদ্ধি পাবে পৃথিবী থেকে তাপ ততই কম নির্গত হবে। যার ফলে পৃথিবী দিন দিন আরও বেশি উত্তপ্ত হবে।
বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ হচ্ছে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়া। তাপমাত্রা অত্যধিক বেড়েছে। চরম অবস্থায় এসেছে আর্দ্রতা। পানির স্তর নেমে গেছে নিচে। অঞ্চলভিত্তিক অসম বৃষ্টিপাত হয়েছে। জলবায়ুর বিরূপতার সঙ্গে আমাদের সরাসরি সংশ্লিষ্টতা কম। কিন্তু ভুক্তভোগী আমরা বেশি। আমরা ভুক্তভোগী কারণ পৃথিবীতে সুবিধাভোগী দলটির যথেচ্ছ অনধিকারচর্চায় সম্পদগুলো ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পৃথিবীর অধিকাংশ সম্পদ ভোগ করছে স্বল্প কয়েকটি দেশ। বেশিরভাগ দেশ বঞ্চিত। পৃথিবীর সাধারণ প্রাকৃতিক সম্পদগুলোও এখন একক কোনো গোষ্ঠী বা দলের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়েছে। সম্পদগুলো হচ্ছে পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূমি, নীল আকাশ, পাহাড়-পর্বত, নদী-সমুদ্র, জলাশয়। এসব সম্পদের প্রাণশক্তিকে ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে নিয়ে গেছে সুবিধাভোগী গোষ্ঠী, যার খেসারত দিতে হয়েছে পৃথিবীর বহু ভূখণ্ডকে। যেমন আমাদের এখন দিতে হচ্ছে। এই চরম সুবিধাবাদী গোষ্ঠীর মানসিকতাকে চিহ্নিত করেছিলেন প্রখ্যাত পরিবেশবিদ অধ্যাপক হার্ডিন। ১৯৬৮ সালে একটি বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নালে হার্ডিন তার এই ধারণাটিকে তুলে ধরেন। তিনি দেখিয়েছিলেন, মধ্যযুগে ইউরোপের বহুবিস্তীর্ণ চারণভূমি পড়ে থাকত উন্মুক্ত। স্বার্থান্বেষী মানুষ তাদের সুযোগ-সুবিধার জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত এই ভূমি মাত্রাতিরিক্তভাবে ব্যবহার করত, যতক্ষণ পর্যন্ত চারণভূমিটি তার উর্বরা শক্তি হারিয়ে রুক্ষ না হয়ে যেত। এরপর তারা চলে যেত অন্য কোথায়ও। তখন স্বাভাবিকভাবেই সেই রুক্ষ ভূমির দায় এসে পড়ত নির্দোষ মানুষ জাতির ঘাড়ে। হার্ডিনের ব্যাখ্যার করুণ সুরটিকে এখন আমরা যেন শুনতে পাচ্ছি। আমাদের প্রতিবেশ এখন সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলে চিহ্নিত। কাদের দোষে? উন্নত দেশগুলো তাদের উন্নয়ন ও আকাশছোঁয়া সমৃদ্ধির জন্য কুক্ষিগত করেছে পৃথিবীর সেসব সাধারণ সম্পদগুলোকে, যার প্রতি অধিকার ছিল সব মানুষের। এর ফলে আমাদের মতো দেশগুলো বিপন্ন হয়েছে। দায় নিতে হচ্ছে উন্নয়নকামী দেশগুলোকে, তাদের দরিদ্র মানুষগুলোকে- যারা হয়ত এই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত নয়। কিন্তু তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে চলতে হচ্ছে এর প্রভাবের সঙ্গে। হতদরিদ্র ও দুস্থ মানুষদের দিতে হচ্ছে মূল্য। তাই কোপেনহেগেন জলবায়ু সম্মেলনে অসংখ্য পরিবেশবাদী এই বলে স্লোগান দিয়েছিল যে, ‘এই পৃথিবী মুনাফার জন্য নয়। বাসযোগ্য আর কোনো পৃথিবীও নেই।’
আমাদের দেশের সেসব পরিবেশবাদী ব্যক্তি, যারা দীর্ঘদিন থেকে আমাদের পরিবেশ বিষয়ে সচেতন করে যাচ্ছেন, তারা তাদের স্বপ্ন, আশা ও আকাঙ্ক্ষার কথাকে সাবলীলভাবে, সুস্পষ্ট প্রত্যয়ে প্রকাশ করে গেছেন। তাদেরই এক অন্যতম প্রবক্তা অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার ৮৪তম জন্মদিবসটি পালিত হল গত ২৯ মে, যখন আমাদের প্রকৃতি রুক্ষ। পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন। নিসর্গ বিষণ্ন। দ্বিজেন শর্মা এই বৈরী পরিবেশের মাঝেও নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যাচ্ছেন রমনা উদ্যানে তরুপল্লবের অনুষ্ঠানে। আগ্রহ সহকারে তাদের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন গাছগাছালির সঙ্গে। নিবিড় উদ্ভিদজগতের সঙ্গে। প্রসন্ন প্রকৃতির সঙ্গে। নিসর্গপ্রেমী, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, সৌন্দর্যপিয়াসী এই মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের বিপন্ন পরিবেশের কথা বলে উত্কণ্ঠা প্রকাশ করে গেছেন। তিনি ভাটির দেশের নানান গাছপালার সৌন্দর্যকে নিবিড়ভাবে উপভোগ করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের প্রকৃতি চেতনায় গভীরভাবে আস্থাশীল। রবীন্দ্রনাথও বৈরী প্রাকৃতিক পরিবেশকে একদা সুষমামণ্ডিত করার প্রয়াসে ব্রতী হয়েছিলেন। দ্বিজেন শর্মা মুগ্ধতায় সেসব প্রয়াসের কথা জানিয়েছেন।
রবীন্দ্রনাথের পরিকল্পিত শান্তিনিকেতন একসময় পরিচিত ছিল ভুবনডাঙ্গার ধূসর মাঠ হিসেবে। স্থানীয় অধিবাসীরা সেই অভিশপ্ত মাঠকে এড়িয়ে চলত। ১২ বছর বয়সে রবীন্দ্রনাথ তার ঋষি পিতার সঙ্গে সেখানে প্রথম যান- অনুর্বর, রুক্ষ খোয়াইডাঙ্গার প্রান্তরে। তার ৬০ বছর পরে সেই স্মৃতিচারণা করেছিলেন, ‘আমার জীবন নিতান্তই অসম্পূর্ণ থাকত প্রথম বয়সে এই সুযোগ যদি আমার না ঘটত। সেই বালক বয়সে এখানকার প্রকৃতি থেকে যে আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, এখানকার অনবরুদ্ধ আকাশ ও মাঠ, দূর হতে প্রতিভাত নীলাভ শাল ও তাল-শ্রেণীর সমুচ্চ শাখাপুঞ্জে শ্যামলা শান্তি স্মৃতির সম্পদরূপে চিরকাল আমার স্বভাবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে।’
রবীন্দ্রনাথ ভুবনডাঙ্গার নিষ্করুণ মাঠের বৈরী পরিবেশকে নিষ্ঠার সঙ্গে নিসর্গমণ্ডিত করে তোলেন। তিনি সেই বিস্তীর্ণ প্রান্তরের বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে-‘ছায়ার রৌদ্রে বিচিত্র লাল কাঁকরের এই নিভৃত জগত্ না দেয় ফল, না দেয় ফুল, না উত্পন্ন করে ফসল।’ সেরকম রুক্ষ প্রকৃতি ও পরিবেশ সচেতন মানুষের কল্যাণে পরিবর্তিত হয়। তারা এমনভাবে এক প্রসন্ন ভুবনকে সৃষ্টি করেন যে সেখানকার ছাতিমতলায় পাথরে খোদিত হয় ‘এখানে আত্মার আরাম’ বাক্যটি। প্রাণহীন, কঙ্করময় প্রান্তরকে তিনি প্রাণময় শিল্পে পরিণত করে গেছেন। শান্তিনিকেতন হয়ে উঠেছিল এক অনবদ্য নিসর্গ স্থাপত্য, যেন মরু বিজয়ের কেতন উড়েছিল সেখানে।
আজ যখন আমাদের ভূখণ্ডটি মরুকরণের বিস্তারে ক্রমশ ধূসর হয়ে আসছে, তখন দ্বিজেন শর্মার চেতনায় রবীন্দ্র প্রকৃতিচর্চার বিশ্বাসকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। আমরা রুক্ষতার অবসান চাই। প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের অবসান চাই।
খোয়াইডাঙ্গার প্রান্তরে দেবেন্দ্রনাথ যে বীজ রোপণ করেছিলেন তাকে রবীন্দ্রনাথ পরম যত্নে লালন করেছেন। বর্ধিত করেছেন। শাখা-প্রশাখায় বিস্তৃত করেছেন। ফুলে-ফলে সমৃদ্ধ করেছেন। এই পরিবর্তনটি এতই স্মরণীয় যে অকুণ্ঠচিত্তে বলা চলে, ‘সেখানে মৃত্যুর মুখে ঘোষিত হয় বিজয়ী প্রাণের জয়বার্তা।’
রবীন্দ্রনাথের প্রেরণায় দিনে দিনে ঋতুতে ঋতুতে সেখানে রোমাঞ্চিত স্পন্দনের বিস্তার ঘটেছে। তাই লিখেছিলেন, ‘আমি ভালোবাসি গাছপালা, ওদের মধ্যে এই ভালোবাসার অনুভূতি প্রবেশ করে, ওদের কাছ থেকে সেই ভালোবাসারই পাই প্রতিদান।’
আমি ব্যক্তিগতভাবে অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মার প্রবল অনুরাগী। তাকে অনেকবার বলেছি-আপনি কিন্তু আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের সেই কিশোর বলাই। যে গাছ কাটলে প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করে।
আমার এই আবেগমথিত কথা শুনে দ্বিজেন শর্মা মৃদু হাসেন। মনে হয় আমার ধারণাটির তিনি বিরোধিতা করেন না। তিনি সঙ্কটের প্রতিবেশ বিষয়ে উত্কণ্ঠা প্রদর্শন করেন। তার পৃষ্ঠপোষকতায় প্রকাশিত ‘প্রকৃতি পত্রে’ থাকে সেই উত্কণ্ঠার কথা। যাতে আমাদের সাম্প্রতিক সময় ক্লিষ্ট।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমানে পৃথিবীর তাপমাত্রা হচ্ছে ৩.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তার দরুন জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে। ধনী দেশগুলোর কারণে কার্বন নিঃসরণ ঘটছে শতকরা ৫১ ভাগ। এই ভয়াবহ সমস্যার সমাধানকল্পে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন দেশে নানা আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রতিবারই মানুষ প্রবল আশা নিয়ে তাকিয়ে থেকেছে সম্মেলনগুলোর দিকে। শুভকর ফললাভের প্রত্যাশা করেছে। কিন্তু আশার বাণী শোনা যায়নি। সমাধানের জন্য বাস্তবভিত্তিক উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের প্রতি গভীর আশায় তাকিয়ে ছিলেন উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিনিধিরা। প্রত্যাশা ছিল ভালো পরিণতির। কিন্তু সেখানেও কোনো সুরাহা হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে, পৃথিবী কি তাহলে এরকম স্বেচ্ছাচারিতায় নিয়ন্ত্রিত হতে থাকবে? পৃথিবীর সকল সম্পদের ওপর সবার সমান অধিকার রয়েছে।
আমাদের দেশের প্রধান পরিবেশবাদী লেখক অধ্যাপক দ্বিজেন শর্মা এখনও ৮৪ বছর বয়সে উদ্যানে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে গিয়ে গাছ চেনাচ্ছে। উদ্ভিদের প্রতি ভালোবাসা জাগাচ্ছেন। এই প্রচণ্ড তাপপ্রবাহের মাঝে তিনি কি আল মাহমুদের মতো বলবেন, ‘লোক নেই, জন নেই পানির পাশে। গাছগুলো মনে হবে দুঃখমাখা।’

লেখক : শিশুসাহিত্যিক

বৃহস্পতিবার, ২৪ মে, ২০১২

প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা



আ লী  ই মা ম
গাঙ্গেয় অববাহিকার আমাদের এই মায়াময় দেশটি নদীমাতৃক বলে পরিচিত। এ দেশের মানুষ মুক্তির আন্দোলনের সময় আবেগতাড়িত হয়ে স্লোগান দিয়েছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। সেই উচ্চারণে ছিল গভীর বিশ্বাস। প্রবল প্রত্যয়। যেন নদীর তরঙ্গ আমাদের জোয়ারে পরিণত করবে। নদীই আমাদের পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের সেই নদীগুলো যখন মরতে বসে আমরা তখন বিপন্নতা বোধ করি। নদীদূষণ মারাত্মক হয়ে আমাদের জীবনযাত্রাকে ক্লিষ্ট করে তোলে। আমরা নদী বাঁচানোর আন্দোলন করতে বাধ্য হই। এগার শতকে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। প্রশস্ত আর গভীর ছিল নদীগুলো। বর্ষাকালে হতো প্রমত্তা। অনেক নদীই হারিয়ে গেছে। মরে গেছে। আজ সর্বসাকুল্যে আমাদের নদীর সংখ্যা ২৩০টি। এর মধ্যে ১০০টি নদীতে নৌ চলাচলের মতো প্রশস্ততা ও পানির গভীরতা রয়েছে। বেশিরভাগ নদীই হারিয়েছে নাব্যতা। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে আমাদের মোট নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিমি। এখন সেই অবস্থা আর নেই। দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। স্বেচ্ছায় নিজেদের ক্ষতি করেছি। নদীর ধারাকে সঙ্কুচিত করেছি। নদীর প্রতি প্রচণ্ড অবহেলা আর অত্যাচার করেছি। নদীর গুরুত্বকে একেবারেই অনুধাবন করতে পারিনি। ফলে নদীর পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কিমি। বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ নদী ব্যাপক ভাঙনের শিকার। নদী দখলের মত মারাত্মক ঘটনায় আমাদের পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। এই দখলজনিত কারণে দেশে ১৫৮টি প্রশস্ত নদী আজ ক্ষীণকায় হয়ে পড়েছে। এখন যেন ভূমিদস্যুদের দখলকারী প্রধান স্থান হয়েছে নদীর জমি। পানির দূষণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে জলজ প্রাণী। মাছের প্রজনন ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে শিল্প-কারখানার বর্জ্য। সারা দেশে নিবন্ধিত ২৭৭টি চামড়া শিল্প থেকে প্রতিদিন ৮.৪৭ মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য নিষ্কাশিত হয়। বৈরী পরিবেশে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে। 
গত ২২ মে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস পালিত হয়েছে। জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই এই উদ্যোগ। আমরা বিপন্ন নদীগুলোর নিঃশেষিত অবস্থার পটভূমিকায় এই দিবসটিকে পালন করেছি। আমাদের কাছে ক্রমশ প্রতীয়মান হচ্ছে জলাশয়ের সমস্যা। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় নদী, জলাশয় অস্বাভবিক হারে কমে গেছে। আমরা তো আকুল কণ্ঠে বলতে চাই, ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?’ এই প্রশ্নের উত্তর হাজার বছর ধরে খুঁজে ফিরছে মানুষ।
পৃথিবীর প্রাচীন উন্নত সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল নদীতীরের পলি জমা উর্বর ভূখণ্ডে। বহতা নদী জীবনের ধারাকে অবিরাম পুষ্ট করে চলে। ফসলের সমৃদ্ধি দেয়। জলজ প্রাণিগুলো রুপালি শস্য হয়ে মানুষের পুষ্টি জোগায়। সেই নদী যখন বিপন্ন হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই জলাশয় তীরবর্তী সভ্যতাও বিপন্ন হয়। তরঙ্গায়িত নদী হচ্ছে জীবনের সজীবতার উত্স। মানুষের সভ্যতা বিকাশে নদীর বিশাল অবদান রয়েছে। মিসরীয় সভ্যতা নীল নদের দান বলে পরিচিত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস প্রথম শতাব্দীতেই এ কথা উচ্চারণ করেছিলেন। মিসরের প্রাচীন রাজধানী মেমফিসে এক পুরাতাত্ত্বিক খননে পুঁথিতে রচিত সৃষ্টিতত্ত্বের এক কাহিনী আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে পানির প্রবহমান ধারার বন্দনা করা হয়েছে। পানির স্রোতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। কাহিনীর প্রধান হচ্ছে আদি সৃষ্টি দেবতা পতাহ। উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে, ‘আদিতে বিশ্বচরাচরে ছিল অসীম জলরাশি। প্রথমে উত্পন্ন হল হূদয় বাসনা। তারপর আতুমের মাঝে ধ্বনি উত্পন্ন হল। তার সৃষ্ট সকল মানুষ, সকল প্রাণী, গবাদিপশু, পক্ষীজাতীয় প্রাণী এবং সকল প্রাণীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং অভিরুচি অনুযায়ী প্রত্যেককে নির্দেশ দিতে লাগলেন। চোখের দৃষ্টি, কানের শ্রবণশক্তি, নাকের ঘ্রাণশক্তি সকলেই হূদয়কে তাদের আপন আপন সংবাদ প্রদানে বাধ্য হল। কারণ হূদয় যা অনুভব করছে, ধ্বনি তা প্রকাশ করতে লাগল।
নীল নদের তীরের অধিবাসীরা তখন প্রতি পদে অনুভব করতে পেরেছিল অবিরাম পানিপ্রবাহের মাধ্যমে তারা কতটা উপকৃত হতে পারছে। মিসরীয় প্রাচীন দেয়ালচিত্রে দেখা যায়, জলজ ঘাসের বনে পাখি শিকারিদের। নানাবিধ জলজ পাখিতে তখন ভরে থাকত ঝোপঝাড়।  সেখানে ছিল খাদ্য।
গত ২২ মে প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদনে এই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, আমাদের দেশের নদীতীরের ঝোপজঙ্গল অস্বাভাবিক কমে গেছে।
মিসরীয় দেয়ালচিত্রে দেখা যায় নদীর ব্যাপক ব্যবহার। সেচ ব্যবস্থা। খাল কেটে পানি নেওয়া। মাছ শিকার। পলিমাটিসমৃদ্ধ উপত্যকায় মানুষ বপন করেছে ফসলের বীজ। তারা ধারণা করত নীল নদের দেবতা বিশাল এক জলাধার থেকে অবিরাম পানি ঢেলেই চলেছে। তারা নীলের দেবতার কাছে এই বলে প্রার্থনা করত : ‘জয় হোক তোমার, হে নীল, তোমাকে ধন্যবাদ। আমাদের দেশকে বাঁচাও, বয়ে যাও ধীরে। যদি তোমার গতি থেমে যায় তবে মরে যায় সব প্রাণ। যদি ক্রুদ্ধ হও তবে দেশে জ্বলবে আগুন। ঘটবে বিপর্যয়। সবাই কাতরাবে দারিদ্র্যে।’
প্রাচীন মিসরীয় সাহিত্যে নানাভাবে নদী বন্দনার কথা এসেছে। নদীর ধারায় তাদের জীবন যে সঞ্জীবিত হয়েছে তার উল্লেখ রয়েছে। একজন লিপিকারের রচনা, ‘নদী সন্নিহিত মাঠ সব ধরনের ভালো ফসলে ভরপুর। খাদ্যের সরবরাহ প্রতিদিন। পুকুরগুলো মাছে ভর্তি। হ্রদে রয়েছে অসংখ্য পাখি। চারণভূমি সবুজ ঘাসে সমাচ্ছন্ন।
পাশে রয়েছে সুস্বাদু খেজুরের সমৃদ্ধ বাগান। নদীতীরের বালিয়াড়িতে তরমুজের সমারোহ। মাড়াই করা গম ও বাজরা এমনভাবে স্তূপীকৃত, যেন তা আকাশ স্পর্শ করছে। পিঁয়াজ ও রসুন, খাদ্যের জন্য প্রস্তুত। বাগানে লেটুসের চাষে ভুল হয়নি। ডালিম, আপেল, জলপাই এবং ডুমুরে প্রতিটি বাগান পরিপূর্ণ। খালে পদ্মফুলের নিচে লাল ওয়েডি মাছের বাস।’
এভাবেই প্রাচীন লিপিকাররা শস্যসমৃদ্ধ জনপদের চিত্র তুলে ধরেছেন। কারণ  তারা নদীর অবদানকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন।
সেই জলধারাকে মানুষ ক্রমাগত বিনষ্ট করেছে। পানিদূষণ ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বিশুদ্ধ পানির স্তরের অবনমন হয়েছে। নদীতে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণীর দূষণে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দূষণপ্রক্রিয়াতে মিষ্টি পানির প্রাণীদের শরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব বাসা বেঁধেছে। নতুন বিশুদ্ধ পানির অভাবজনিত দূষণে এদের জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। প্রজননে অক্ষমতা ও অকালমৃত্যুর কারণ হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে ভয়াবহ এক অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এশিয়ার প্রায় প্রতিটি নদীই পয়ঃপ্রণালীর ময়লা ও জঞ্জালে বন্ধ হয়ে নর্দমার আকার ধারণ করেছে। কৃত্রিম উপায়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন সমস্যাকে বৃদ্ধি করেছে। প্রাণিকুলের বংশবিস্তারের পরিবেশ আশঙ্কাজনকভাবে নষ্ট হয়েছে। পানির পরিমাণ ও গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। হুমকির মুখে এখন জলাভূমির প্রাণবৈচিত্র্য। অস্তিত্ব সঙ্কটে ২৬০ প্রজাতির মাছ।
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে মাছ ধরা, অতিরিক্ত জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ ও জলাভূমি ভরাট করে কৃষিজমি তৈরির মাধ্যমে জলজ প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে। এ দেশের প্রায় ৪০০ প্রজাতির প্রাণী এবং ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল। দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে জলাভূমির পরিমাণ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে শুকনো মৌসুমে জলাভূমিতে পানি কমে যাওয়াতে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মাছ ও জলজ প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। ইতোমধ্যে টাঙ্গুয়া, হাকালুকির হাওরসহ পাঁচটি জলাভূমিকে প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জলাভূমির বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ নির্বিচারে আহরণের ফলে পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে জলাভূমি । এ ধরনের অবস্থা অব্যাহত থাকলে ধ্বংস হয়ে যাবে জলাভূমির প্রাণবৈচিত্র্য। হাকালুকির হাওরে ৩২ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতে বসেছে। সেখানকার মদনটাক, মেছো ঈগল, কালিম পাখি সঙ্কটাপন্ন। গত ২২ মে’র জীববৈচিত্র্য দিবসে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত। বলেছেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার খুবই বিপন্ন দশা। কোনো একটি প্রজাতির বিলুপ্তি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একে সামান্য দুর্ঘটনাও বলা যাবে না। এর ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। খরা ও বন্যা নদী অববাহিকার পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। জীবনহানি ঘটাচ্ছে। অত্যধিক আবর্জনা ও পলি সঞ্চয় পৃথিবীর অধিকাংশ নদীকে স্থবির করে তুলছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ভয়ঙ্করভাবে পানির অভাবে পড়বে। পৃথিবীর সব স্বাদু ও বিশুদ্ধ পানির ভাণ্ডারের অর্থনৈতিক মূল্য হল ৭০০০ কোটি ডলারের মতো। অথচ এর মাত্র এক শতাংশ ঠিকভাবে মানুষের ব্যবহারে আসে। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষই মাঝারি থেকে বড় ধরনের পানির অভাবের মাঝে রয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ পরিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। ৩০০ কোটি মানুষের প্রকৃত পয়ঃপ্রণালীর সুবিধা নেই। প্রতিবছর ৩০ লাখ লোক পানিবাহিত রোগে মৃত্যুবরণ করে থাকে। উন্নত দেশগুলো প্রায় ৩০-৪০ গুণ বেশি ব্যবহার করছে। এই অপচয়ের সঙ্গেই তারা প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টন আবর্জনা নিক্ষেপ করছে নদীবক্ষে।
প্রাচীন মিসরের আখেন-আটনের বন্দনাগীতিতে পাঁচ হাজার বছর আগে বলা হয়েছিল, ‘তুমি প্রকৃতিকে বিভক্ত করেছ ঋতুতে। শীত আনে শীতলতা, কুয়াশা। তোমার রশ্মির উত্তাপ শুষে নেয় ফসলের, প্রাণীর, মানুষের নির্জীব শিথিলতা। তোমার গ্রীষ্ম মানুষের জন্য স্বেদযুক্ত। কিন্তু ফসলের জন্য আস্বাদ প্রদায়ী। তুমিই সৃৃষ্টি করেছ অনন্ত আকাশ। তোমার বর্ণিল যাত্রাপথ।’ বর্তমানের দূষিত পরিবেশের মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা এই প্রাচীন উক্তি এবং বিশ্বাসের মূল্যায়ন কীভাবে করব?
আদি অনন্তকালের অসীম, অফুরন্ত পানির প্রবাহ সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তনের সময় এসেছে। রাষ্ট্রসংঘ এই সমস্যার গভীরতা বিশ্লেষণ করে বর্তমান দশককে ‘পানি দশক’ বলে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন নদী অববাহিকা ও ২৫ কোটি হেক্টর জলাভূমিকে সংরক্ষণ ও পরিশোধন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত ১০০ বছরে পৃথিবীর স্বাদু জলাভূমির পরিমাণকে অর্ধেক করে ফেলা হয়েছে। গত ৩০ বছরে পরিশুদ্ধ পানির প্রাণীদের অর্ধেককে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো মিষ্টি পানির মাছেরা আজ বিলুপ্তির পথে। পরিবেশবিদদের মতে, কোনো স্থানের ইকোসিস্টেম একবার বিনষ্ট হয়ে গেলে তা আর ফিরে আসে না। ফলে দেশের কোনো জলাভূমির ইকোসিস্টেম যদি ভেঙে পড়ে তা হলে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই আগে থেকেই আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন এই সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কি না।
আজ থেকে পৌনে দুইশ’ বছর আগে একজন রেড ইন্ডিয়ান সর্দার নিউইয়র্কের প্রশাসকের উদ্দেশে একটি পত্র দিয়েছিলেন। 
পরিবেশ সচেতনতার দিক থেকে ওই পত্রটি এক অসাধারণ দলিল হিসেবে বিবেচিত। সেই পত্রের এক স্থানে ছিল, ‘নদীরা আমাদের ভাই। তারা আমাদর তৃষ্ণা মেটায়। নদীরা আমাদের নৌকা বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার জোটায়। যদি আমরা আমাদের দেশ তোমাদের দিই তাহলে তোমরা মনে রেখো, তোমাদের ছেলেমেয়েদের শিখিও যে নদীরা মানুষের ভাই। সুতরাং তোমরা নদীদের সেরকমই যত্ন করো, যেমন তোমরা তোমাদের ভাইদের করো। প্রতিটি জিনিসই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা। যেমন রক্তের সম্পর্ক একটা পরিবারের লোকদের বেঁধে রাখে। সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা। এই পৃথিবীর যা হবে পৃথিবীর সন্তানদেরও তাই হবে। জীবনের এই ছড়ানো জাল, মানুষ একে বোনেনি। সে কেবল এর একটি সুতো মাত্র। এই জালটিকে সে যা করবে তার নিজেরও ঠিক তাই হবে।
ঝোপজঙ্গলগুলো কোথায়? নেই।
বেঁচে থাকা। শেষ। কোনোরকমে টিকে থাকা শুধু।’ আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান সর্দারের এই চিঠি আমাদের চেতনাকে আঘাত করে। কীভাবে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে সভ্যতাকে বিনাশ করেছে তা ভাবতে শেখায়।
আমরা জানি, সুপ্রাচীন টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস উপত্যকার সভ্যতার পতনের কারণ হল প্রকৃতি বিভ্রাট। এখন আমরা সন্দেহ করি গুয়াতেমালার কোলে খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতাব্দী থেকে নয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গড়ে ওঠা মায়া সভ্যতার পতনের কারণও হল প্রকৃতি বিভ্রাট। উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত সুপ্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের গম ভাণ্ডার এক অন্তহীন মরুভূমি। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস উপত্যকার সুসভ্য মানুষরা জানতে পারেনি যে তারা অবলুপ্ত হবেন। গুয়াতেমালার তদানীন্তন  শিক্ষিত মানুষরা বোঝেনি যে তারা হারিয়ে যাবেন। সুসভ্য প্রাচীন রোমানরা বোঝেননি যে তাদের শস্যভাণ্ডার ধ্বংস হয়ে যাবে। হাজার হাজার বছরে ধরে গড়ে ওঠা মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের খতিয়ান দেখতে গিয়ে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন মানুষ আবার প্রকৃতি বিভ্রাটের সম্মুখীন। মানুষ আবার সার্বিক অবলুপ্তির মুখোমুখি।
পৃথিবীর স্থলভাগের শতকরা ছয় ভাগ হল জলাভূমি। প্রতিটি জলাভূমিতে একটি বিশেষ ইকোসিস্টেম আছে। অনুমান করা হয়, জলাভূমির ইকোসিস্টেম বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। তাই জলাভূমি হারালে হারায় বিশেষ বিশেষ প্রজাতি। বাস্তুসংস্থানে ঘটে বিভ্রাট। বিঘ্নিত হয় জলবায়ু। ব্যাহত হয় অর্থনীতি। বিকৃত হয়ে যায় সভ্যতা। মিষ্টি পানির আধারগুলোও কিছুটা বায়োডাইভার্সিটির উত্স। তিন ধরনের মিষ্টি পানির আধার আছে-নদী, হ্রদ এবং স্থলভূমির অন্যান্য জলাশয়। স্থলজ প্রজাতির সংখ্যা থেকে জলজ প্রজাতির সংখ্যা বেশি। কিন্তু ডাইভার্সিটি কম। জলাশয়ের ইকোসিস্টেমে পাওয়া যায় মাছ এবং কঠিন খোলাযুক্ত প্রাণী বা ক্রাসটেসিয়া। আন্তর্জাতিক বিচারে এসব ইকোসিস্টেমের চেয়ে নদী এবং হ্রদের ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব অনেক বেশি। ট্রপিকাল নদীগুলোও বিভিন্ন বাস্তুসংস্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং বিভিন্ন প্রজাতিতে ভরপুর।
বায়োডাইভার্সিটির বিচারে যেসব হ্রদের নাম উল্লেখযোগ্য সেগুলোর মধ্যে আছে আফ্রিকার মালাওয়াই, টাংগানাইকা এবং ভিক্টোরিয়া হ্রদ। এসব হ্রদের ২৫০+ প্রজাতির মাছ আছে। শতকরা ৮০ ভাগ মাছ মাত্র একটি ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত। এদের বলা হয় সিকইলড। এই মাছ পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। মিষ্টি পানির জলাশয়গুলোর ইকোসিস্টেমের অনুকূল মাছের বংশবৃদ্ধির প্রয়োজন জীবভাণ্ডার হিসেবে। এ ছাড়া জলবায়ু সংরক্ষণেও এদের নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে।
আর্দ্র বনভূমি, শুষ্ক বনভূমি, চারণভূমি, নিষ্পাদপ ভূমি, মরুভূমি, জলাভূমি, হ্রদ, সমুদ্র, তটরেখা, পাহাড়-এ সবই প্রকৃতির অঙ্গ। প্রতিটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট ইকোসিস্টেম। প্রাণী, উদ্ভিদ ও মানুষের সমাবেশ। এদের সবাইকে নিয়েই বাস্তুসংস্থান বা ইকোলজি। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটি ভঙ্গুর, ভারসাম্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। প্রকৃতির এই পারস্পরিক বিন্যাস সব অংশেই বিশেষ মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ওজোন স্তরে ছিদ্র, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেটিক চেঞ্জ এবং বায়োডাইভার্সিটির অবলুপ্তি এসব একসূত্রে বাঁধা। একইসূত্রে বাঁধা রয়েছে দারিদ্র্য, গরিব দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন, ধনী দেশগুলোর দ্বারা গরিব দেশগুলোর শোষণ এবং সভ্যতার অপব্যাখ্যা।
আমরা যেন প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হই।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক

বৃহস্পতিবার, ১৭ মে, ২০১২

আমাদের গ্রহটি বাঁচাতে হবে



আ লী  ই মা ম
যখন এ লেখাটি লিখছি তখন চারপাশের প্রকৃতিতে বিরাজ করছে ভয়ানক উত্তপ্ত অবস্থা। সমস্ত দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলেছে তীব্র তাপপ্রবাহ, পুড়ছে দেশ। অসহনীয় গরমে হাঁসফাঁস করছে মানুষ। স্বাভাবিক জীবনের গতি চরমভাবে ব্যাহত হচ্ছে। উত্তপ্ত পৃথিবীর বাসিন্দা এখন আমরা। এখন বায়ুপ্রবাহে আগুনের হলকা, যেন ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস’। বুঝি বৃক্ষহীন মরুভূমির মাঝে অতিবাহিত হচ্ছে আমাদের ধূসর জীবন। আর আমাদের ক্লান্ত, বিমর্ষ করছে। চারপাশ থেকে অপসৃত হয়েছে সবুজ-শ্যামলিমার প্রসন্নতা। নির্বাক, নীল, নির্মম মহাকাশ। প্রকৃতির এই ভয়ঙ্কর অবস্থা পরিবেশবিদদের চিন্তিত করে তোলে। সমস্যার উত্স অনুসন্ধানে তারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। পরিবেশের এই ভয়াবহ দূষণের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে ব্যাপক আলোচিত গ্রিনহাউস ইফেক্টের কথা। আমাদের ভূখণ্ড একদা শ্যামল প্রকৃতিতে প্রসন্ন ছিল। উদ্ভিদের নিবিড় জগত্ প্রকৃতিকে স্নিগ্ধ করে রেখেছিল। এখন জলবায়ুর পরিবর্তনজনিত তীব্র সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি। প্রতিনিয়ত বিপর্যস্ত হচ্ছে আমাদের যাপিত জীবন। প্রকৃতি হয়েছে বৈরী। পরিবেশ হয়েছে রুক্ষ। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এই সমস্যাকে প্রকট করেছে। আমরা আত্মবিনাশী আচরণ করেছি। এ যেন বৃক্ষের ওপরে নয়, নিজের পায়েই কুড়াল মারা হয়েছে। আমাদের পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের  এই লেখার শিরোনামের বিবরণটি এখন উপহাসে পরিণত হয়েছে। বাতাস এখন তপ্ত নিঃশ্বাস। এই তাপপ্রবাহে বিপর্যস্ত হয়ে আমরা আবার সেই বৃক্ষবন্দনায় নিবেদিত হতে চাই। অনুভব করতে চাই শ্যামলী নিসর্গকে।
বৃক্ষ পরিচর্যায় সম্রাট আশোক তার দ্বিতীয় গিরিশাসনে জানিয়েছেন, ‘যেখানে যেসব গাছ, ফলমূল নেই আমি তা অন্য জায়গা থেকে এনে লাগিয়েছি। পথের ধারে বৃক্ষরোপণ করিয়েছি। পশু ও মানুষের চিকিত্সার কাজে যেসব ভেষজ ঔষধি লাগে, তা-ও এনে লাগানো হয়েছে যেখানে নেই সেখানকার মাটিতে।’ এই উক্তি ছিল আড়াই হাজার বছর আগের। সেই শুভবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে বন সৃজিত হয়েছিল। আমরা সেই বনাঞ্চলের চরম বিনাশ করেছি। প্রকৃতিকে বৈরী করে তুলেছি। নিষ্ঠুর হয়ে প্রকৃতি তার শোধ নিয়েছে। এখন তাপদাহে পুড়ছে দেশ।
প্রখ্যাত লেখক এইচজি ওয়েলস সম্রাট আশোকের পাথরে উত্কীর্ণ এই বাণী পাঠ করে লিখেছিলেন, একধরনের পানি, মাটি, বাতাস থেকে অন্যরকমের আবহে এই গাছপালার স্থানান্তরকরণ প্রক্রিয়ায় আশোক তার প্রথম উদ্যোক্তা হিসেবে পৃথিবীর উদ্ভিদবিজ্ঞানের ইতিহাসেও বিশেষ স্থান করে নিয়েছেন। বৃক্ষপ্রেমিক আশোকের কর্তব্যনিষ্ঠা আমাদের কল্যাণের জন্য অনুধাবন করা উচিত। সম্রাটের এক রানী বোধিবৃক্ষটিকে নষ্ট করে দিতে চাইছিলেন। সম্রাট যখন সংবাদ পেলেন যে মহীরুহটি মৃতপ্রায়, তখন ছুটে গেলেন তার পরিচর্যা করতে। গাছে পানি ঢেলে সতেজ করলেন। একসময় সবুজ পাতায় সেই ছায়াতরুটি ভরে উঠল। সাঁচিস্তূপের দক্ষিণ তোরণে বৃক্ষপ্রেমিক অশোকের সেই ছবিটি ধরা আছে।
আমরা কল্যাণবোধের কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করিনি। পৃথিবীর এই বৈরী পরিবেশের পরিপ্রেক্ষিত জানার চেষ্টা করেছেন পরিবেশবিদরা। দূষণের মূল কারণ কী, যাতে পৃথিবী নামক গ্রহের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে উঠছে। ’৭৩ সালে রিয়োতে অনুষ্ঠিত প্রথম ধরিত্রী সম্মেলনের মূল স্লোগান ছিল, আমাদের গ্রহটিকে রক্ষা করুন।
প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে মানুষের সংগ্রাম দীর্ঘদিনের। প্রায় দুই লাখ বছর আগে আবহাওয়ার আকস্মিক পরিবর্তনের কারণে বিলুপ্তির মুখে পড়া পৃথিবীর অবশিষ্ট সামান্য কিছু মানুষ সম্ভবত ছোট্ট একটি জায়গায় আশ্রয় নিয়ে জীবন রক্ষা করেছিল। আর এভাবেই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পায় মানবজাতি। কয়েকজন বিজ্ঞানী জায়গাটিকে ডাকছেন ‘হেভেন অব ইডেন’ বা স্বর্গোদ্যান নামে।
নতুন এক গবেষণায় বলা হচ্ছে, গুটিকয়েক মানুষ যে অনুকূল জায়গাটিতে আশ্রয় নিয়ে বরফযুগের প্রতিকূল আবহাওয়া থেকে বেঁচে যায়, তার অবস্থান আফ্রিকার দক্ষিণ উপকূলে, দক্ষিণ আফ্রিকার কেপটাউনের প্রায় ২৪০ কিলোমিটার দূরে।
বিজ্ঞানীরা বলেন, ১ লাখ ৯৫ হাজার বছর আগে পৃথিবীর তাপমাত্রার আকস্মিক পরিবর্তনে বিশ্বের অন্যত্র নানা প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যায়। তাদের ধারণা, অন্য প্রজাতির প্রাণীর তুলনায় মানুষের জেনেটিক বৈচিত্র্য কম হওয়ার এটি একটি সম্ভাব্য কারণ। কয়েকজন বিজ্ঞানীর ধারণা, ওই সময় পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা মাত্র কয়েকশ’তে নেমে এসেছিল। পৃথিবীতে পালা করে সর্বব্যাপী শৈত্যের বরফযুগ এসেছে, যার সর্বশেষটি ঘটেছিল আজ থেকে হাজার দশেক বছর আগে। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটির দি ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান অরিজিনসের অধ্যাপক কার্টিস মারিয়েন দক্ষিণ আফ্রিকার ‘পিনাকল পয়েন্ট’ নামে পরিচিত সমুদ্র উপকূলবর্তী ওই প্রত্যন্ত জায়গায় গুহার মধ্যে প্রাচীন মানুষের ব্যবহূত কিছু জিনিস আবিষ্কার করেছেন।
অধ্যাপক মারিয়েন বলেন, ‘হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষের বিকাশ শুরু হওয়ার কিছু সময় পরই বিরূপ জলবায়ু মানবজাতিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল।’ তিনি বলেন, সাম্প্রতিক পাওয়া কিছু তথ্যে এ ইঙ্গিত মিলছে যে, টিকে যাওয়া ক্ষুদ্র একটি জনগোষ্ঠী থেকেই বর্তমান মনুষ্য জাতির উদ্ভব। তারা আফ্রিকার ওই ক্ষুদ্র জায়গাটিরই সম্পদের দক্ষ ব্যবহারের মাধ্যমে বেঁচে ছিল। নিকটস্থ সাগর এবং এলাকাটির সমৃদ্ধ উদ্ভিদজগত্ ছিল তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্যের একটি বড় উত্স। মারিয়েন বলেন, গুহাগুলোয় কমপক্ষে ১ লাখ ৬৪ হাজার বছরের পুরনো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া গেছে।
লন্ডনের ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের মানবজাতির উদ্ভব সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ক্রিস স্ট্রিঙ্গার বলেন, প্রাচীন মানুষের বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশ সম্পর্কে অধ্যাপক মারিয়েনের তত্ত্বের সঙ্গে তিনি একমত। তবে ক্ষুদ্র একদল মানুষ আধুনিক মানবজাতির উত্স-এই বক্তব্য তিনি পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না।
অনেক গবেষকেরই ধারণা, প্রায় ১ লাখ ৯৫ হাজার বছর আগে পূর্ব আফ্রিকায় আধুনিক মানুষের উদ্ভব ঘটে। ৫০ হাজার বছরের মধ্যেই তারা মহাদেশের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে।
ধারণা করা হয়, ৭০ হাজার বছর আগে এক শুষ্ক যুগে লোহিত সাগরের পানির স্তর নেমে গিয়েছিল। সাগরের মুখ সঙ্কুচিত হয়ে ১৮ মাইল থেকে ৮ মাইলে নেমে আসে। আর এ সুযোগে একটি জনগোষ্ঠী সাগর পাড়ি দিয়ে আফ্রিকা থেকে আরবে প্রবেশ করে। পরিবেশ দূষণের কারণে বহু সভ্যতার বিলুপ্তি ঘটেছিল। আমাদের তাই অবহিত হতে হবে কী কারণে অতীতের সভ্যতা নিশ্চিহ্ন হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ধানের কারণ হিসেবে সাম্প্রতিক গবেষণায় বলা হয়েছে যে, ক্রমবর্ধমান ঊষরতা এর জন্য দায়ী। আমাদের ভূমিতেও যে রকম মরুকরণ প্রক্রিয়া চলছে তাতে আশঙ্কা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
নদীগুলো যাচ্ছে শুকিয়ে। বিস্তৃত হচ্ছে বালির চরা। সিন্ধু সভ্যতা অবলুপ্তির কারণ অনুসন্ধানে লবণাক্ত হ্রদ থেকে পাওয়া পরাগরেণুর নমুনা গবেষণা করে বলা হয়েছে যে, প্রায় ২২৩০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ক্রমশ কমে আসার ফলে আবহাওয়া শুষ্ক হতে শুরু করেছিল। যে জন্য নদীগুলো শুকিয়ে গিয়েছিল। সিন্ধু লোকালয়ে বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘনিয়ে এসেছিল, যার আঘাত সেই সভ্যতা আর সামলে উঠতে পারেনি। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, মানুষের সৃষ্ট ছিল সেই বিপর্যয়। সিন্ধুর মানুষজনের বেপরোয়া ভূমি কর্ষণ, ক্রমবর্ধিত চারণক্ষেত্রের ব্যবহার, অরণ্যাদি বিনষ্ট করায় ক্ষতি ত্বরান্বিত হয়েছে। এর পরিণতিতে সে স্থানের মৃত্তিকা সে সময়ের জনগোষ্ঠীকে আর জীবনযাপনের উপকরণ সরবরাহ করতে পারেনি।
পৃথিবীর সাম্প্রতিক বৈরী পরিবেশের কারণ হিসেবে পরিবেশবিদরা দায়ী করছেন মাত্রাতিরিক্ত কার্বন যৌগের ব্যবহার, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন ও বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে। মানুষের সৃষ্ট নানা কারণে এখন পরিবেশের ওপর জলবায়ু পরিবর্তনের এই প্রভাব সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। জীববৈচিত্র্য প্রচণ্ড হুমকির মুখে পড়েছে। পরিবেশের ভারসাম্য বিনষ্ট হয়েছে। মলিন বাতাসে, বিষণ্ন পরিবেশে কালাতিপাত করতে করতে আমরা এই সমস্যার ভয়াবহ রূপকে প্রত্যক্ষ করছি। এই তাপপ্রবাহ যেন মুক্ত, বিশুদ্ধ স্নিগ্ধ বাতাসকে অপসৃত করেছে। এখন শ্বাস নিতে কষ্ট। পরিস্রুত পানি দুর্লভ হয়ে উঠছে। সঠিকভাবে বাতাস আর পানি পাওয়া না গেলে জীবন স্বাভাবিকভাবেই নিরানন্দ হয়ে ওঠে। আমরা এখন সেই নিরানন্দকাল অতিক্রম করছি। অবস্থান করছি বিমুখ প্রান্তরে। পার্থিব জগতের সবকিছুর মাঝে বাতাসের সঙ্গেই আমাদের সবচেয়ে নিবিড় সম্পর্ক। বেঁচে থাকার অপরিহার্য উপাদান হচ্ছে বাতাস এবং পানি। যার সরবরাহে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে উদ্ভিদজগতের তৈরি প্রতিবেশ ব্যবস্থা। আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে পানি আর বাতাস এই দুটো জড়বস্তুর ওপর। প্রসন্ন বাতাসকে ঘিরে প্রাণ সজীবতা পায়। প্রতিদিন পানি ও বাতাসের সঙ্গে জগত্সংসারের সকল প্রাণী এবং উদ্ভিদের আলিঙ্গন ঘটছে পরম বন্ধুর মতো। বাতাস নিয়ে আসছে ফুলের সৌরভ। পৃথিবীর যাবতীয় প্রাণসত্তাকে জড়িয়ে রেখেছে বায়ুমণ্ডলের একটি পুরু চাদর। সেই পৃথিবী এখন প্রতিনিয়ত উত্তপ্ত হচ্ছে। কার্বন-ডাই-অক্সাইড জমা হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে। সূর্যের আলো আমাদের পৃথিবীর তাপ বাড়িয়ে দেয়। পৃথিবী সেই তাপকে বিকিরণ করে একটা সাম্য অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে জমে থাকা অজস্র  বর্জ্য কার্বন-ডাই-অক্সাইড ও ধুলোবালি সেই বিকীর্ণ তাপের অনেকটাই ধরে রাখে। কিন্তু কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ যত বেড়ে যাবে তার তাপ ধরে রাখার ক্ষমতা তত বেড়ে চলবে, ফলে সমস্ত পৃথিবী আরও বেশি উষ্ণ হবে। এটাই গ্রিনহাউস ইফেক্ট।
পৃথিবীতে আবহাওয়ার গতিবিধি খুবই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। বৃষ্টিপাতের পরিমাণও দিনের পর দিন বদলে যাচ্ছে। পরিবর্তিত হচ্ছে বায়ুপ্রবাহের পথনির্দেশ। পৃথিবীপৃষ্ঠের ওপরের ওজোন স্তর পাতলা হয়ে আসছে। কোথাও ফুটো হয়ে গেছে। ওজোন স্তর থাকার ফলে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি পৃথিবীতে প্রবেশ করতে পারে না। এই আলো এসে পৃথিবীতে আছড়ে পড়লে জীবজগতের অস্তিত্ব সঙ্কটে পড়বে।
রেফ্রিজারেটরে ব্যবহূত রাসায়নিক বস্তু সিএফসি ওজোন স্তরকে বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ওজোন স্তর ফুটো হয়ে যাওয়াতে পৃথিবীর পরিবেশ এত বেশি উত্তপ্ত হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা থেকে জানা গেছে, গত দুই শতাব্দীতে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় শূন্য দশমিক ছয় ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। আবহাওয়াতে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়েছে ৩৫ শতাংশ। শুধু গত চার দশকেই এর এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে। বিজ্ঞানীদের হিসাব অনুযায়ী এ শতাব্দীর শেষে সুমেরু অঞ্চলে স্থলভাগের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে তিন থেকে পাঁচ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। এর ফলে বরফ গলে প্লাবিত হবে সমুদ্র বা নদী উপকূলবর্তী বেশ কিছু অঞ্চল।
প্রখ্যাত পরিবেশ বিজ্ঞানী ড. ওয়ালেস ব্রোকার মন্তব্য করেছিলেন, ‘আবহাওয়া যেন একটা ক্ষ্যাপা জন্তু। আর মানুষ তাকে ক্রমাগত খুঁচিয়ে চলছে একটা ছুঁচালো লাঠি দিয়ে। কিয়োটো চুক্তি অনুযায়ী কার্বন-ডাই-অক্সাইড বা মিথেনের মতো কিছু গ্যাসের উত্পাদন কমানোর কথা পৃথিবীর সব দেশের। এই গ্রিনহাউস গ্যাস পৃথিবীর আবহাওয়াতে একটা আস্তরণ তৈরি করে। তার ফলে পৃথিবীর তাপ দূরাকাশে বিকীর্ণ হতে পারে না।
কিয়োটো প্রটোকল এখন অনেক উন্নত দেশই মানছে না। তারা পৃথিবী নামক গ্রহের সম্ভাব্য বিপদ নিয়ে ভাবছে না। তাদের আচরণ আত্মকেন্দ্রিক। বিশ্বায়নের সুযোগে বহু দেশ তাদের নিজস্ব স্বার্থসিদ্ধির জন্য পৃথিবীর বিশাল এক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রাকে বিপন্ন করে তুলছে। 
ধনী দেশগুলোর ভোগবিলাস সামগ্রীর মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে সৃষ্ট যে সিএফসি ওজোন স্তরকে বিপন্ন করে আবহাওয়ার পরিবর্তন ঘটাচ্ছে তা এখন নৈতিকতার দিক থেকেও প্রশ্নবিদ্ধ। আবহাওয়াজনিত পরিবর্তনের প্রাকৃতিক দুর্যোগের খেসারত দিতে হচ্ছে অগুনতি মানুষকে। রাষ্ট্রসংঘের পরিবেশ বিষয়ক পরামর্শক সংস্থার প্রধান অধ্যাপক কেভিল ট্রেনবার্থ সম্প্রতি বলেছেন, পৃথিবীতে বেশ কয়েকটি জায়গায় হারিকেন ঘূর্ণিঝড়ের অন্যতম কারণ পৃথিবীর আবহাওয়া বদল। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিপদ অন্যরকম উপলব্ধির সৃষ্টি করছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের বিপদে জন্য মূল দোষী হচ্ছে বায়ুমণ্ডলে কার্বনভুক্ত পদার্থের উপস্থিতি। পরিবেশদূষণ হচ্ছে আধুনিক পৃথিবীর সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তা। সাধারণ মানুষও এখন পরিবেশ নিয়ে নানা চিন্তাভাবনা করছে। বলা চলে করতে বাধ্য হচ্ছে। গ্রিনহাউস ইফেক্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর তাপমাত্রা। ওজোন স্তরের পর্দাকে প্রতিনিয়ত পাতলা করে চলেছে সিএফসি, যেন পৃথিবীর আকাশের পর্দা ফেটে চৌচির হতে চলেছে। নানা প্রক্রিয়ায় দূষিত হচ্ছে নরম মাটি, নদী-নালা, সাগরের পানি, বায়ুপ্রবাহ।

এখন তাই আর্তকণ্ঠে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে- 
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু 
নিভাইছে তব আলো, 
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ 
তুমি কি বেসেছ ভালো?
লেখক : শিশুসাহিত্যিক