আ লী ই মা ম
গাঙ্গেয় অববাহিকার আমাদের এই মায়াময় দেশটি নদীমাতৃক বলে পরিচিত। এ দেশের মানুষ মুক্তির আন্দোলনের সময় আবেগতাড়িত হয়ে স্লোগান দিয়েছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। সেই উচ্চারণে ছিল গভীর বিশ্বাস। প্রবল প্রত্যয়। যেন নদীর তরঙ্গ আমাদের জোয়ারে পরিণত করবে। নদীই আমাদের পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের সেই নদীগুলো যখন মরতে বসে আমরা তখন বিপন্নতা বোধ করি। নদীদূষণ মারাত্মক হয়ে আমাদের জীবনযাত্রাকে ক্লিষ্ট করে তোলে। আমরা নদী বাঁচানোর আন্দোলন করতে বাধ্য হই। এগার শতকে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। প্রশস্ত আর গভীর ছিল নদীগুলো। বর্ষাকালে হতো প্রমত্তা। অনেক নদীই হারিয়ে গেছে। মরে গেছে। আজ সর্বসাকুল্যে আমাদের নদীর সংখ্যা ২৩০টি। এর মধ্যে ১০০টি নদীতে নৌ চলাচলের মতো প্রশস্ততা ও পানির গভীরতা রয়েছে। বেশিরভাগ নদীই হারিয়েছে নাব্যতা। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে আমাদের মোট নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিমি। এখন সেই অবস্থা আর নেই। দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। স্বেচ্ছায় নিজেদের ক্ষতি করেছি। নদীর ধারাকে সঙ্কুচিত করেছি। নদীর প্রতি প্রচণ্ড অবহেলা আর অত্যাচার করেছি। নদীর গুরুত্বকে একেবারেই অনুধাবন করতে পারিনি। ফলে নদীর পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কিমি। বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ নদী ব্যাপক ভাঙনের শিকার। নদী দখলের মত মারাত্মক ঘটনায় আমাদের পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। এই দখলজনিত কারণে দেশে ১৫৮টি প্রশস্ত নদী আজ ক্ষীণকায় হয়ে পড়েছে। এখন যেন ভূমিদস্যুদের দখলকারী প্রধান স্থান হয়েছে নদীর জমি। পানির দূষণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে জলজ প্রাণী। মাছের প্রজনন ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে শিল্প-কারখানার বর্জ্য। সারা দেশে নিবন্ধিত ২৭৭টি চামড়া শিল্প থেকে প্রতিদিন ৮.৪৭ মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য নিষ্কাশিত হয়। বৈরী পরিবেশে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
গত ২২ মে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস পালিত হয়েছে। জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই এই উদ্যোগ। আমরা বিপন্ন নদীগুলোর নিঃশেষিত অবস্থার পটভূমিকায় এই দিবসটিকে পালন করেছি। আমাদের কাছে ক্রমশ প্রতীয়মান হচ্ছে জলাশয়ের সমস্যা। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় নদী, জলাশয় অস্বাভবিক হারে কমে গেছে। আমরা তো আকুল কণ্ঠে বলতে চাই, ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?’ এই প্রশ্নের উত্তর হাজার বছর ধরে খুঁজে ফিরছে মানুষ।
পৃথিবীর প্রাচীন উন্নত সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল নদীতীরের পলি জমা উর্বর ভূখণ্ডে। বহতা নদী জীবনের ধারাকে অবিরাম পুষ্ট করে চলে। ফসলের সমৃদ্ধি দেয়। জলজ প্রাণিগুলো রুপালি শস্য হয়ে মানুষের পুষ্টি জোগায়। সেই নদী যখন বিপন্ন হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই জলাশয় তীরবর্তী সভ্যতাও বিপন্ন হয়। তরঙ্গায়িত নদী হচ্ছে জীবনের সজীবতার উত্স। মানুষের সভ্যতা বিকাশে নদীর বিশাল অবদান রয়েছে। মিসরীয় সভ্যতা নীল নদের দান বলে পরিচিত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস প্রথম শতাব্দীতেই এ কথা উচ্চারণ করেছিলেন। মিসরের প্রাচীন রাজধানী মেমফিসে এক পুরাতাত্ত্বিক খননে পুঁথিতে রচিত সৃষ্টিতত্ত্বের এক কাহিনী আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে পানির প্রবহমান ধারার বন্দনা করা হয়েছে। পানির স্রোতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। কাহিনীর প্রধান হচ্ছে আদি সৃষ্টি দেবতা পতাহ। উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে, ‘আদিতে বিশ্বচরাচরে ছিল অসীম জলরাশি। প্রথমে উত্পন্ন হল হূদয় বাসনা। তারপর আতুমের মাঝে ধ্বনি উত্পন্ন হল। তার সৃষ্ট সকল মানুষ, সকল প্রাণী, গবাদিপশু, পক্ষীজাতীয় প্রাণী এবং সকল প্রাণীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং অভিরুচি অনুযায়ী প্রত্যেককে নির্দেশ দিতে লাগলেন। চোখের দৃষ্টি, কানের শ্রবণশক্তি, নাকের ঘ্রাণশক্তি সকলেই হূদয়কে তাদের আপন আপন সংবাদ প্রদানে বাধ্য হল। কারণ হূদয় যা অনুভব করছে, ধ্বনি তা প্রকাশ করতে লাগল।
নীল নদের তীরের অধিবাসীরা তখন প্রতি পদে অনুভব করতে পেরেছিল অবিরাম পানিপ্রবাহের মাধ্যমে তারা কতটা উপকৃত হতে পারছে। মিসরীয় প্রাচীন দেয়ালচিত্রে দেখা যায়, জলজ ঘাসের বনে পাখি শিকারিদের। নানাবিধ জলজ পাখিতে তখন ভরে থাকত ঝোপঝাড়। সেখানে ছিল খাদ্য।
গত ২২ মে প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদনে এই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, আমাদের দেশের নদীতীরের ঝোপজঙ্গল অস্বাভাবিক কমে গেছে।
মিসরীয় দেয়ালচিত্রে দেখা যায় নদীর ব্যাপক ব্যবহার। সেচ ব্যবস্থা। খাল কেটে পানি নেওয়া। মাছ শিকার। পলিমাটিসমৃদ্ধ উপত্যকায় মানুষ বপন করেছে ফসলের বীজ। তারা ধারণা করত নীল নদের দেবতা বিশাল এক জলাধার থেকে অবিরাম পানি ঢেলেই চলেছে। তারা নীলের দেবতার কাছে এই বলে প্রার্থনা করত : ‘জয় হোক তোমার, হে নীল, তোমাকে ধন্যবাদ। আমাদের দেশকে বাঁচাও, বয়ে যাও ধীরে। যদি তোমার গতি থেমে যায় তবে মরে যায় সব প্রাণ। যদি ক্রুদ্ধ হও তবে দেশে জ্বলবে আগুন। ঘটবে বিপর্যয়। সবাই কাতরাবে দারিদ্র্যে।’
প্রাচীন মিসরীয় সাহিত্যে নানাভাবে নদী বন্দনার কথা এসেছে। নদীর ধারায় তাদের জীবন যে সঞ্জীবিত হয়েছে তার উল্লেখ রয়েছে। একজন লিপিকারের রচনা, ‘নদী সন্নিহিত মাঠ সব ধরনের ভালো ফসলে ভরপুর। খাদ্যের সরবরাহ প্রতিদিন। পুকুরগুলো মাছে ভর্তি। হ্রদে রয়েছে অসংখ্য পাখি। চারণভূমি সবুজ ঘাসে সমাচ্ছন্ন।
পাশে রয়েছে সুস্বাদু খেজুরের সমৃদ্ধ বাগান। নদীতীরের বালিয়াড়িতে তরমুজের সমারোহ। মাড়াই করা গম ও বাজরা এমনভাবে স্তূপীকৃত, যেন তা আকাশ স্পর্শ করছে। পিঁয়াজ ও রসুন, খাদ্যের জন্য প্রস্তুত। বাগানে লেটুসের চাষে ভুল হয়নি। ডালিম, আপেল, জলপাই এবং ডুমুরে প্রতিটি বাগান পরিপূর্ণ। খালে পদ্মফুলের নিচে লাল ওয়েডি মাছের বাস।’
এভাবেই প্রাচীন লিপিকাররা শস্যসমৃদ্ধ জনপদের চিত্র তুলে ধরেছেন। কারণ তারা নদীর অবদানকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন।
সেই জলধারাকে মানুষ ক্রমাগত বিনষ্ট করেছে। পানিদূষণ ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বিশুদ্ধ পানির স্তরের অবনমন হয়েছে। নদীতে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণীর দূষণে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দূষণপ্রক্রিয়াতে মিষ্টি পানির প্রাণীদের শরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব বাসা বেঁধেছে। নতুন বিশুদ্ধ পানির অভাবজনিত দূষণে এদের জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। প্রজননে অক্ষমতা ও অকালমৃত্যুর কারণ হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে ভয়াবহ এক অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এশিয়ার প্রায় প্রতিটি নদীই পয়ঃপ্রণালীর ময়লা ও জঞ্জালে বন্ধ হয়ে নর্দমার আকার ধারণ করেছে। কৃত্রিম উপায়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন সমস্যাকে বৃদ্ধি করেছে। প্রাণিকুলের বংশবিস্তারের পরিবেশ আশঙ্কাজনকভাবে নষ্ট হয়েছে। পানির পরিমাণ ও গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। হুমকির মুখে এখন জলাভূমির প্রাণবৈচিত্র্য। অস্তিত্ব সঙ্কটে ২৬০ প্রজাতির মাছ।
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে মাছ ধরা, অতিরিক্ত জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ ও জলাভূমি ভরাট করে কৃষিজমি তৈরির মাধ্যমে জলজ প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে। এ দেশের প্রায় ৪০০ প্রজাতির প্রাণী এবং ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল। দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে জলাভূমির পরিমাণ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে শুকনো মৌসুমে জলাভূমিতে পানি কমে যাওয়াতে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মাছ ও জলজ প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। ইতোমধ্যে টাঙ্গুয়া, হাকালুকির হাওরসহ পাঁচটি জলাভূমিকে প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জলাভূমির বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ নির্বিচারে আহরণের ফলে পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে জলাভূমি । এ ধরনের অবস্থা অব্যাহত থাকলে ধ্বংস হয়ে যাবে জলাভূমির প্রাণবৈচিত্র্য। হাকালুকির হাওরে ৩২ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতে বসেছে। সেখানকার মদনটাক, মেছো ঈগল, কালিম পাখি সঙ্কটাপন্ন। গত ২২ মে’র জীববৈচিত্র্য দিবসে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত। বলেছেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার খুবই বিপন্ন দশা। কোনো একটি প্রজাতির বিলুপ্তি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একে সামান্য দুর্ঘটনাও বলা যাবে না। এর ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। খরা ও বন্যা নদী অববাহিকার পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। জীবনহানি ঘটাচ্ছে। অত্যধিক আবর্জনা ও পলি সঞ্চয় পৃথিবীর অধিকাংশ নদীকে স্থবির করে তুলছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ভয়ঙ্করভাবে পানির অভাবে পড়বে। পৃথিবীর সব স্বাদু ও বিশুদ্ধ পানির ভাণ্ডারের অর্থনৈতিক মূল্য হল ৭০০০ কোটি ডলারের মতো। অথচ এর মাত্র এক শতাংশ ঠিকভাবে মানুষের ব্যবহারে আসে। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষই মাঝারি থেকে বড় ধরনের পানির অভাবের মাঝে রয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ পরিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। ৩০০ কোটি মানুষের প্রকৃত পয়ঃপ্রণালীর সুবিধা নেই। প্রতিবছর ৩০ লাখ লোক পানিবাহিত রোগে মৃত্যুবরণ করে থাকে। উন্নত দেশগুলো প্রায় ৩০-৪০ গুণ বেশি ব্যবহার করছে। এই অপচয়ের সঙ্গেই তারা প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টন আবর্জনা নিক্ষেপ করছে নদীবক্ষে।
প্রাচীন মিসরের আখেন-আটনের বন্দনাগীতিতে পাঁচ হাজার বছর আগে বলা হয়েছিল, ‘তুমি প্রকৃতিকে বিভক্ত করেছ ঋতুতে। শীত আনে শীতলতা, কুয়াশা। তোমার রশ্মির উত্তাপ শুষে নেয় ফসলের, প্রাণীর, মানুষের নির্জীব শিথিলতা। তোমার গ্রীষ্ম মানুষের জন্য স্বেদযুক্ত। কিন্তু ফসলের জন্য আস্বাদ প্রদায়ী। তুমিই সৃৃষ্টি করেছ অনন্ত আকাশ। তোমার বর্ণিল যাত্রাপথ।’ বর্তমানের দূষিত পরিবেশের মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা এই প্রাচীন উক্তি এবং বিশ্বাসের মূল্যায়ন কীভাবে করব?
আদি অনন্তকালের অসীম, অফুরন্ত পানির প্রবাহ সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তনের সময় এসেছে। রাষ্ট্রসংঘ এই সমস্যার গভীরতা বিশ্লেষণ করে বর্তমান দশককে ‘পানি দশক’ বলে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন নদী অববাহিকা ও ২৫ কোটি হেক্টর জলাভূমিকে সংরক্ষণ ও পরিশোধন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত ১০০ বছরে পৃথিবীর স্বাদু জলাভূমির পরিমাণকে অর্ধেক করে ফেলা হয়েছে। গত ৩০ বছরে পরিশুদ্ধ পানির প্রাণীদের অর্ধেককে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো মিষ্টি পানির মাছেরা আজ বিলুপ্তির পথে। পরিবেশবিদদের মতে, কোনো স্থানের ইকোসিস্টেম একবার বিনষ্ট হয়ে গেলে তা আর ফিরে আসে না। ফলে দেশের কোনো জলাভূমির ইকোসিস্টেম যদি ভেঙে পড়ে তা হলে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই আগে থেকেই আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন এই সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কি না।
আজ থেকে পৌনে দুইশ’ বছর আগে একজন রেড ইন্ডিয়ান সর্দার নিউইয়র্কের প্রশাসকের উদ্দেশে একটি পত্র দিয়েছিলেন।
পরিবেশ সচেতনতার দিক থেকে ওই পত্রটি এক অসাধারণ দলিল হিসেবে বিবেচিত। সেই পত্রের এক স্থানে ছিল, ‘নদীরা আমাদের ভাই। তারা আমাদর তৃষ্ণা মেটায়। নদীরা আমাদের নৌকা বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার জোটায়। যদি আমরা আমাদের দেশ তোমাদের দিই তাহলে তোমরা মনে রেখো, তোমাদের ছেলেমেয়েদের শিখিও যে নদীরা মানুষের ভাই। সুতরাং তোমরা নদীদের সেরকমই যত্ন করো, যেমন তোমরা তোমাদের ভাইদের করো। প্রতিটি জিনিসই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা। যেমন রক্তের সম্পর্ক একটা পরিবারের লোকদের বেঁধে রাখে। সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা। এই পৃথিবীর যা হবে পৃথিবীর সন্তানদেরও তাই হবে। জীবনের এই ছড়ানো জাল, মানুষ একে বোনেনি। সে কেবল এর একটি সুতো মাত্র। এই জালটিকে সে যা করবে তার নিজেরও ঠিক তাই হবে।
ঝোপজঙ্গলগুলো কোথায়? নেই।
বেঁচে থাকা। শেষ। কোনোরকমে টিকে থাকা শুধু।’ আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান সর্দারের এই চিঠি আমাদের চেতনাকে আঘাত করে। কীভাবে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে সভ্যতাকে বিনাশ করেছে তা ভাবতে শেখায়।
আমরা জানি, সুপ্রাচীন টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস উপত্যকার সভ্যতার পতনের কারণ হল প্রকৃতি বিভ্রাট। এখন আমরা সন্দেহ করি গুয়াতেমালার কোলে খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতাব্দী থেকে নয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গড়ে ওঠা মায়া সভ্যতার পতনের কারণও হল প্রকৃতি বিভ্রাট। উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত সুপ্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের গম ভাণ্ডার এক অন্তহীন মরুভূমি। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস উপত্যকার সুসভ্য মানুষরা জানতে পারেনি যে তারা অবলুপ্ত হবেন। গুয়াতেমালার তদানীন্তন শিক্ষিত মানুষরা বোঝেনি যে তারা হারিয়ে যাবেন। সুসভ্য প্রাচীন রোমানরা বোঝেননি যে তাদের শস্যভাণ্ডার ধ্বংস হয়ে যাবে। হাজার হাজার বছরে ধরে গড়ে ওঠা মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের খতিয়ান দেখতে গিয়ে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন মানুষ আবার প্রকৃতি বিভ্রাটের সম্মুখীন। মানুষ আবার সার্বিক অবলুপ্তির মুখোমুখি।
পৃথিবীর স্থলভাগের শতকরা ছয় ভাগ হল জলাভূমি। প্রতিটি জলাভূমিতে একটি বিশেষ ইকোসিস্টেম আছে। অনুমান করা হয়, জলাভূমির ইকোসিস্টেম বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। তাই জলাভূমি হারালে হারায় বিশেষ বিশেষ প্রজাতি। বাস্তুসংস্থানে ঘটে বিভ্রাট। বিঘ্নিত হয় জলবায়ু। ব্যাহত হয় অর্থনীতি। বিকৃত হয়ে যায় সভ্যতা। মিষ্টি পানির আধারগুলোও কিছুটা বায়োডাইভার্সিটির উত্স। তিন ধরনের মিষ্টি পানির আধার আছে-নদী, হ্রদ এবং স্থলভূমির অন্যান্য জলাশয়। স্থলজ প্রজাতির সংখ্যা থেকে জলজ প্রজাতির সংখ্যা বেশি। কিন্তু ডাইভার্সিটি কম। জলাশয়ের ইকোসিস্টেমে পাওয়া যায় মাছ এবং কঠিন খোলাযুক্ত প্রাণী বা ক্রাসটেসিয়া। আন্তর্জাতিক বিচারে এসব ইকোসিস্টেমের চেয়ে নদী এবং হ্রদের ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব অনেক বেশি। ট্রপিকাল নদীগুলোও বিভিন্ন বাস্তুসংস্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং বিভিন্ন প্রজাতিতে ভরপুর।
বায়োডাইভার্সিটির বিচারে যেসব হ্রদের নাম উল্লেখযোগ্য সেগুলোর মধ্যে আছে আফ্রিকার মালাওয়াই, টাংগানাইকা এবং ভিক্টোরিয়া হ্রদ। এসব হ্রদের ২৫০+ প্রজাতির মাছ আছে। শতকরা ৮০ ভাগ মাছ মাত্র একটি ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত। এদের বলা হয় সিকইলড। এই মাছ পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। মিষ্টি পানির জলাশয়গুলোর ইকোসিস্টেমের অনুকূল মাছের বংশবৃদ্ধির প্রয়োজন জীবভাণ্ডার হিসেবে। এ ছাড়া জলবায়ু সংরক্ষণেও এদের নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে।
আর্দ্র বনভূমি, শুষ্ক বনভূমি, চারণভূমি, নিষ্পাদপ ভূমি, মরুভূমি, জলাভূমি, হ্রদ, সমুদ্র, তটরেখা, পাহাড়-এ সবই প্রকৃতির অঙ্গ। প্রতিটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট ইকোসিস্টেম। প্রাণী, উদ্ভিদ ও মানুষের সমাবেশ। এদের সবাইকে নিয়েই বাস্তুসংস্থান বা ইকোলজি। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটি ভঙ্গুর, ভারসাম্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। প্রকৃতির এই পারস্পরিক বিন্যাস সব অংশেই বিশেষ মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ওজোন স্তরে ছিদ্র, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেটিক চেঞ্জ এবং বায়োডাইভার্সিটির অবলুপ্তি এসব একসূত্রে বাঁধা। একইসূত্রে বাঁধা রয়েছে দারিদ্র্য, গরিব দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন, ধনী দেশগুলোর দ্বারা গরিব দেশগুলোর শোষণ এবং সভ্যতার অপব্যাখ্যা।
আমরা যেন প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হই।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক
গাঙ্গেয় অববাহিকার আমাদের এই মায়াময় দেশটি নদীমাতৃক বলে পরিচিত। এ দেশের মানুষ মুক্তির আন্দোলনের সময় আবেগতাড়িত হয়ে স্লোগান দিয়েছিল, ‘তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা’। সেই উচ্চারণে ছিল গভীর বিশ্বাস। প্রবল প্রত্যয়। যেন নদীর তরঙ্গ আমাদের জোয়ারে পরিণত করবে। নদীই আমাদের পথ দেখিয়ে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। আমাদের সেই নদীগুলো যখন মরতে বসে আমরা তখন বিপন্নতা বোধ করি। নদীদূষণ মারাত্মক হয়ে আমাদের জীবনযাত্রাকে ক্লিষ্ট করে তোলে। আমরা নদী বাঁচানোর আন্দোলন করতে বাধ্য হই। এগার শতকে বাংলাদেশে নদীর সংখ্যা ছিল প্রায় দেড় হাজার। প্রশস্ত আর গভীর ছিল নদীগুলো। বর্ষাকালে হতো প্রমত্তা। অনেক নদীই হারিয়ে গেছে। মরে গেছে। আজ সর্বসাকুল্যে আমাদের নদীর সংখ্যা ২৩০টি। এর মধ্যে ১০০টি নদীতে নৌ চলাচলের মতো প্রশস্ততা ও পানির গভীরতা রয়েছে। বেশিরভাগ নদীই হারিয়েছে নাব্যতা। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭১ সালে আমাদের মোট নদীপথ ছিল ২৪ হাজার ১৪০ কিমি। এখন সেই অবস্থা আর নেই। দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়েছি আমরা। স্বেচ্ছায় নিজেদের ক্ষতি করেছি। নদীর ধারাকে সঙ্কুচিত করেছি। নদীর প্রতি প্রচণ্ড অবহেলা আর অত্যাচার করেছি। নদীর গুরুত্বকে একেবারেই অনুধাবন করতে পারিনি। ফলে নদীর পানিপ্রবাহ কমে গিয়ে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮০০ কিমি। বাংলাদেশের ৪১ শতাংশ নদী ব্যাপক ভাঙনের শিকার। নদী দখলের মত মারাত্মক ঘটনায় আমাদের পরিবেশ বিপন্ন হয়েছে। এই দখলজনিত কারণে দেশে ১৫৮টি প্রশস্ত নদী আজ ক্ষীণকায় হয়ে পড়েছে। এখন যেন ভূমিদস্যুদের দখলকারী প্রধান স্থান হয়েছে নদীর জমি। পানির দূষণে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে জলজ প্রাণী। মাছের প্রজনন ক্ষমতাকে হ্রাস করেছে শিল্প-কারখানার বর্জ্য। সারা দেশে নিবন্ধিত ২৭৭টি চামড়া শিল্প থেকে প্রতিদিন ৮.৪৭ মিলিয়ন লিটার তরল বর্জ্য নিষ্কাশিত হয়। বৈরী পরিবেশে জীববৈচিত্র্য বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
গত ২২ মে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক জীববৈচিত্র্য দিবস পালিত হয়েছে। জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে সচেতন করতেই এই উদ্যোগ। আমরা বিপন্ন নদীগুলোর নিঃশেষিত অবস্থার পটভূমিকায় এই দিবসটিকে পালন করেছি। আমাদের কাছে ক্রমশ প্রতীয়মান হচ্ছে জলাশয়ের সমস্যা। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় প্রয়োজনীয় নদী, জলাশয় অস্বাভবিক হারে কমে গেছে। আমরা তো আকুল কণ্ঠে বলতে চাই, ‘নদী, তুমি কোথা হইতে আসিয়াছ?’ এই প্রশ্নের উত্তর হাজার বছর ধরে খুঁজে ফিরছে মানুষ।
পৃথিবীর প্রাচীন উন্নত সভ্যতাগুলো গড়ে উঠেছিল নদীতীরের পলি জমা উর্বর ভূখণ্ডে। বহতা নদী জীবনের ধারাকে অবিরাম পুষ্ট করে চলে। ফসলের সমৃদ্ধি দেয়। জলজ প্রাণিগুলো রুপালি শস্য হয়ে মানুষের পুষ্টি জোগায়। সেই নদী যখন বিপন্ন হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই জলাশয় তীরবর্তী সভ্যতাও বিপন্ন হয়। তরঙ্গায়িত নদী হচ্ছে জীবনের সজীবতার উত্স। মানুষের সভ্যতা বিকাশে নদীর বিশাল অবদান রয়েছে। মিসরীয় সভ্যতা নীল নদের দান বলে পরিচিত। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস প্রথম শতাব্দীতেই এ কথা উচ্চারণ করেছিলেন। মিসরের প্রাচীন রাজধানী মেমফিসে এক পুরাতাত্ত্বিক খননে পুঁথিতে রচিত সৃষ্টিতত্ত্বের এক কাহিনী আবিষ্কৃত হয়েছে, যাতে পানির প্রবহমান ধারার বন্দনা করা হয়েছে। পানির স্রোতের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়েছে। কাহিনীর প্রধান হচ্ছে আদি সৃষ্টি দেবতা পতাহ। উপাখ্যানে বর্ণিত হয়েছে, ‘আদিতে বিশ্বচরাচরে ছিল অসীম জলরাশি। প্রথমে উত্পন্ন হল হূদয় বাসনা। তারপর আতুমের মাঝে ধ্বনি উত্পন্ন হল। তার সৃষ্ট সকল মানুষ, সকল প্রাণী, গবাদিপশু, পক্ষীজাতীয় প্রাণী এবং সকল প্রাণীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং অভিরুচি অনুযায়ী প্রত্যেককে নির্দেশ দিতে লাগলেন। চোখের দৃষ্টি, কানের শ্রবণশক্তি, নাকের ঘ্রাণশক্তি সকলেই হূদয়কে তাদের আপন আপন সংবাদ প্রদানে বাধ্য হল। কারণ হূদয় যা অনুভব করছে, ধ্বনি তা প্রকাশ করতে লাগল।
নীল নদের তীরের অধিবাসীরা তখন প্রতি পদে অনুভব করতে পেরেছিল অবিরাম পানিপ্রবাহের মাধ্যমে তারা কতটা উপকৃত হতে পারছে। মিসরীয় প্রাচীন দেয়ালচিত্রে দেখা যায়, জলজ ঘাসের বনে পাখি শিকারিদের। নানাবিধ জলজ পাখিতে তখন ভরে থাকত ঝোপঝাড়। সেখানে ছিল খাদ্য।
গত ২২ মে প্রকাশিত জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির প্রতিবেদনে এই বলে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে যে, আমাদের দেশের নদীতীরের ঝোপজঙ্গল অস্বাভাবিক কমে গেছে।
মিসরীয় দেয়ালচিত্রে দেখা যায় নদীর ব্যাপক ব্যবহার। সেচ ব্যবস্থা। খাল কেটে পানি নেওয়া। মাছ শিকার। পলিমাটিসমৃদ্ধ উপত্যকায় মানুষ বপন করেছে ফসলের বীজ। তারা ধারণা করত নীল নদের দেবতা বিশাল এক জলাধার থেকে অবিরাম পানি ঢেলেই চলেছে। তারা নীলের দেবতার কাছে এই বলে প্রার্থনা করত : ‘জয় হোক তোমার, হে নীল, তোমাকে ধন্যবাদ। আমাদের দেশকে বাঁচাও, বয়ে যাও ধীরে। যদি তোমার গতি থেমে যায় তবে মরে যায় সব প্রাণ। যদি ক্রুদ্ধ হও তবে দেশে জ্বলবে আগুন। ঘটবে বিপর্যয়। সবাই কাতরাবে দারিদ্র্যে।’
প্রাচীন মিসরীয় সাহিত্যে নানাভাবে নদী বন্দনার কথা এসেছে। নদীর ধারায় তাদের জীবন যে সঞ্জীবিত হয়েছে তার উল্লেখ রয়েছে। একজন লিপিকারের রচনা, ‘নদী সন্নিহিত মাঠ সব ধরনের ভালো ফসলে ভরপুর। খাদ্যের সরবরাহ প্রতিদিন। পুকুরগুলো মাছে ভর্তি। হ্রদে রয়েছে অসংখ্য পাখি। চারণভূমি সবুজ ঘাসে সমাচ্ছন্ন।
পাশে রয়েছে সুস্বাদু খেজুরের সমৃদ্ধ বাগান। নদীতীরের বালিয়াড়িতে তরমুজের সমারোহ। মাড়াই করা গম ও বাজরা এমনভাবে স্তূপীকৃত, যেন তা আকাশ স্পর্শ করছে। পিঁয়াজ ও রসুন, খাদ্যের জন্য প্রস্তুত। বাগানে লেটুসের চাষে ভুল হয়নি। ডালিম, আপেল, জলপাই এবং ডুমুরে প্রতিটি বাগান পরিপূর্ণ। খালে পদ্মফুলের নিচে লাল ওয়েডি মাছের বাস।’
এভাবেই প্রাচীন লিপিকাররা শস্যসমৃদ্ধ জনপদের চিত্র তুলে ধরেছেন। কারণ তারা নদীর অবদানকে প্রত্যক্ষ করতে পেরেছিলেন।
সেই জলধারাকে মানুষ ক্রমাগত বিনষ্ট করেছে। পানিদূষণ ভয়াবহ সমস্যা সৃষ্টি করেছে। বিশুদ্ধ পানির স্তরের অবনমন হয়েছে। নদীতে বসবাসকারী সমস্ত প্রাণীর দূষণে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই দূষণপ্রক্রিয়াতে মিষ্টি পানির প্রাণীদের শরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব বাসা বেঁধেছে। নতুন বিশুদ্ধ পানির অভাবজনিত দূষণে এদের জন্মহার হ্রাস পেয়েছে। প্রজননে অক্ষমতা ও অকালমৃত্যুর কারণ হয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক একটি প্রতিবেদনে ভয়াবহ এক অবস্থার কথা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এশিয়ার প্রায় প্রতিটি নদীই পয়ঃপ্রণালীর ময়লা ও জঞ্জালে বন্ধ হয়ে নর্দমার আকার ধারণ করেছে। কৃত্রিম উপায়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন সমস্যাকে বৃদ্ধি করেছে। প্রাণিকুলের বংশবিস্তারের পরিবেশ আশঙ্কাজনকভাবে নষ্ট হয়েছে। পানির পরিমাণ ও গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। হুমকির মুখে এখন জলাভূমির প্রাণবৈচিত্র্য। অস্তিত্ব সঙ্কটে ২৬০ প্রজাতির মাছ।
পরিবেশবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন, পরিবেশ দূষণ, নির্বিচারে মাছ ধরা, অতিরিক্ত জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহ ও জলাভূমি ভরাট করে কৃষিজমি তৈরির মাধ্যমে জলজ প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস করা হয়েছে। এ দেশের প্রায় ৪০০ প্রজাতির প্রাণী এবং ৩০০ প্রজাতির উদ্ভিদ জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল। দিনে দিনে কমতে শুরু করেছে জলাভূমির পরিমাণ। জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে শুকনো মৌসুমে জলাভূমিতে পানি কমে যাওয়াতে জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়েছে। মাছ ও জলজ প্রাণীদের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে। ইতোমধ্যে টাঙ্গুয়া, হাকালুকির হাওরসহ পাঁচটি জলাভূমিকে প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। জলাভূমির বিভিন্ন প্রাণী ও উদ্ভিদ নির্বিচারে আহরণের ফলে পাখি ও জলজ প্রাণীর আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত সঙ্কুচিত হয়ে আসছে জলাভূমি । এ ধরনের অবস্থা অব্যাহত থাকলে ধ্বংস হয়ে যাবে জলাভূমির প্রাণবৈচিত্র্য। হাকালুকির হাওরে ৩২ প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হতে বসেছে। সেখানকার মদনটাক, মেছো ঈগল, কালিম পাখি সঙ্কটাপন্ন। গত ২২ মে’র জীববৈচিত্র্য দিবসে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ড. আইনুন নিশাত। বলেছেন, জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কোনো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকার খুবই বিপন্ন দশা। কোনো একটি প্রজাতির বিলুপ্তি একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। একে সামান্য দুর্ঘটনাও বলা যাবে না। এর ভৌগোলিক ও পরিবেশগত কারণগুলোকে অস্বীকার করা যায় না। খরা ও বন্যা নদী অববাহিকার পরিবেশ-প্রতিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছে। জীবনহানি ঘটাচ্ছে। অত্যধিক আবর্জনা ও পলি সঞ্চয় পৃথিবীর অধিকাংশ নদীকে স্থবির করে তুলছে। আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে যে, ২০২৫ সালের মধ্যে পৃথিবীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ ভয়ঙ্করভাবে পানির অভাবে পড়বে। পৃথিবীর সব স্বাদু ও বিশুদ্ধ পানির ভাণ্ডারের অর্থনৈতিক মূল্য হল ৭০০০ কোটি ডলারের মতো। অথচ এর মাত্র এক শতাংশ ঠিকভাবে মানুষের ব্যবহারে আসে। পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ মানুষই মাঝারি থেকে বড় ধরনের পানির অভাবের মাঝে রয়েছে। প্রায় ১০০ কোটি মানুষ পরিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত। ৩০০ কোটি মানুষের প্রকৃত পয়ঃপ্রণালীর সুবিধা নেই। প্রতিবছর ৩০ লাখ লোক পানিবাহিত রোগে মৃত্যুবরণ করে থাকে। উন্নত দেশগুলো প্রায় ৩০-৪০ গুণ বেশি ব্যবহার করছে। এই অপচয়ের সঙ্গেই তারা প্রতিদিন প্রায় ২০ লাখ টন আবর্জনা নিক্ষেপ করছে নদীবক্ষে।
প্রাচীন মিসরের আখেন-আটনের বন্দনাগীতিতে পাঁচ হাজার বছর আগে বলা হয়েছিল, ‘তুমি প্রকৃতিকে বিভক্ত করেছ ঋতুতে। শীত আনে শীতলতা, কুয়াশা। তোমার রশ্মির উত্তাপ শুষে নেয় ফসলের, প্রাণীর, মানুষের নির্জীব শিথিলতা। তোমার গ্রীষ্ম মানুষের জন্য স্বেদযুক্ত। কিন্তু ফসলের জন্য আস্বাদ প্রদায়ী। তুমিই সৃৃষ্টি করেছ অনন্ত আকাশ। তোমার বর্ণিল যাত্রাপথ।’ বর্তমানের দূষিত পরিবেশের মাঝে দাঁড়িয়ে আমরা এই প্রাচীন উক্তি এবং বিশ্বাসের মূল্যায়ন কীভাবে করব?
আদি অনন্তকালের অসীম, অফুরন্ত পানির প্রবাহ সম্পর্কে ধারণা পরিবর্তনের সময় এসেছে। রাষ্ট্রসংঘ এই সমস্যার গভীরতা বিশ্লেষণ করে বর্তমান দশককে ‘পানি দশক’ বলে চিহ্নিত করেছে। বিভিন্ন নদী অববাহিকা ও ২৫ কোটি হেক্টর জলাভূমিকে সংরক্ষণ ও পরিশোধন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। গত ১০০ বছরে পৃথিবীর স্বাদু জলাভূমির পরিমাণকে অর্ধেক করে ফেলা হয়েছে। গত ৩০ বছরে পরিশুদ্ধ পানির প্রাণীদের অর্ধেককে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, প্রায় ২০ থেকে ৩০ শতাংশের মতো মিষ্টি পানির মাছেরা আজ বিলুপ্তির পথে। পরিবেশবিদদের মতে, কোনো স্থানের ইকোসিস্টেম একবার বিনষ্ট হয়ে গেলে তা আর ফিরে আসে না। ফলে দেশের কোনো জলাভূমির ইকোসিস্টেম যদি ভেঙে পড়ে তা হলে তা আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই আগে থেকেই আমাদের সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। আমাদের অবহিত হওয়া প্রয়োজন এই সমস্যাকে চিহ্নিত করা হয়েছিল কি না।
আজ থেকে পৌনে দুইশ’ বছর আগে একজন রেড ইন্ডিয়ান সর্দার নিউইয়র্কের প্রশাসকের উদ্দেশে একটি পত্র দিয়েছিলেন।
পরিবেশ সচেতনতার দিক থেকে ওই পত্রটি এক অসাধারণ দলিল হিসেবে বিবেচিত। সেই পত্রের এক স্থানে ছিল, ‘নদীরা আমাদের ভাই। তারা আমাদর তৃষ্ণা মেটায়। নদীরা আমাদের নৌকা বয়ে নিয়ে যায়। আমাদের ছেলেমেয়েদের মুখে খাবার জোটায়। যদি আমরা আমাদের দেশ তোমাদের দিই তাহলে তোমরা মনে রেখো, তোমাদের ছেলেমেয়েদের শিখিও যে নদীরা মানুষের ভাই। সুতরাং তোমরা নদীদের সেরকমই যত্ন করো, যেমন তোমরা তোমাদের ভাইদের করো। প্রতিটি জিনিসই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা। যেমন রক্তের সম্পর্ক একটা পরিবারের লোকদের বেঁধে রাখে। সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে বাঁধা। এই পৃথিবীর যা হবে পৃথিবীর সন্তানদেরও তাই হবে। জীবনের এই ছড়ানো জাল, মানুষ একে বোনেনি। সে কেবল এর একটি সুতো মাত্র। এই জালটিকে সে যা করবে তার নিজেরও ঠিক তাই হবে।
ঝোপজঙ্গলগুলো কোথায়? নেই।
বেঁচে থাকা। শেষ। কোনোরকমে টিকে থাকা শুধু।’ আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ান সর্দারের এই চিঠি আমাদের চেতনাকে আঘাত করে। কীভাবে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে সভ্যতাকে বিনাশ করেছে তা ভাবতে শেখায়।
আমরা জানি, সুপ্রাচীন টাইগ্রিস ইউফ্রেটিস উপত্যকার সভ্যতার পতনের কারণ হল প্রকৃতি বিভ্রাট। এখন আমরা সন্দেহ করি গুয়াতেমালার কোলে খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতাব্দী থেকে নয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যে গড়ে ওঠা মায়া সভ্যতার পতনের কারণও হল প্রকৃতি বিভ্রাট। উত্তর আফ্রিকায় অবস্থিত সুপ্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের গম ভাণ্ডার এক অন্তহীন মরুভূমি। টাইগ্রিস-ইউফ্রেটিস উপত্যকার সুসভ্য মানুষরা জানতে পারেনি যে তারা অবলুপ্ত হবেন। গুয়াতেমালার তদানীন্তন শিক্ষিত মানুষরা বোঝেনি যে তারা হারিয়ে যাবেন। সুসভ্য প্রাচীন রোমানরা বোঝেননি যে তাদের শস্যভাণ্ডার ধ্বংস হয়ে যাবে। হাজার হাজার বছরে ধরে গড়ে ওঠা মানুষ ও প্রকৃতির সম্পর্কের খতিয়ান দেখতে গিয়ে অনেক বিজ্ঞানী মনে করেন মানুষ আবার প্রকৃতি বিভ্রাটের সম্মুখীন। মানুষ আবার সার্বিক অবলুপ্তির মুখোমুখি।
পৃথিবীর স্থলভাগের শতকরা ছয় ভাগ হল জলাভূমি। প্রতিটি জলাভূমিতে একটি বিশেষ ইকোসিস্টেম আছে। অনুমান করা হয়, জলাভূমির ইকোসিস্টেম বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত। তাই জলাভূমি হারালে হারায় বিশেষ বিশেষ প্রজাতি। বাস্তুসংস্থানে ঘটে বিভ্রাট। বিঘ্নিত হয় জলবায়ু। ব্যাহত হয় অর্থনীতি। বিকৃত হয়ে যায় সভ্যতা। মিষ্টি পানির আধারগুলোও কিছুটা বায়োডাইভার্সিটির উত্স। তিন ধরনের মিষ্টি পানির আধার আছে-নদী, হ্রদ এবং স্থলভূমির অন্যান্য জলাশয়। স্থলজ প্রজাতির সংখ্যা থেকে জলজ প্রজাতির সংখ্যা বেশি। কিন্তু ডাইভার্সিটি কম। জলাশয়ের ইকোসিস্টেমে পাওয়া যায় মাছ এবং কঠিন খোলাযুক্ত প্রাণী বা ক্রাসটেসিয়া। আন্তর্জাতিক বিচারে এসব ইকোসিস্টেমের চেয়ে নদী এবং হ্রদের ইকোসিস্টেমের গুরুত্ব অনেক বেশি। ট্রপিকাল নদীগুলোও বিভিন্ন বাস্তুসংস্থানের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় এবং বিভিন্ন প্রজাতিতে ভরপুর।
বায়োডাইভার্সিটির বিচারে যেসব হ্রদের নাম উল্লেখযোগ্য সেগুলোর মধ্যে আছে আফ্রিকার মালাওয়াই, টাংগানাইকা এবং ভিক্টোরিয়া হ্রদ। এসব হ্রদের ২৫০+ প্রজাতির মাছ আছে। শতকরা ৮০ ভাগ মাছ মাত্র একটি ফ্যামিলির অন্তর্ভুক্ত। এদের বলা হয় সিকইলড। এই মাছ পৃথিবীর অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। মিষ্টি পানির জলাশয়গুলোর ইকোসিস্টেমের অনুকূল মাছের বংশবৃদ্ধির প্রয়োজন জীবভাণ্ডার হিসেবে। এ ছাড়া জলবায়ু সংরক্ষণেও এদের নির্দিষ্ট ভূমিকা আছে।
আর্দ্র বনভূমি, শুষ্ক বনভূমি, চারণভূমি, নিষ্পাদপ ভূমি, মরুভূমি, জলাভূমি, হ্রদ, সমুদ্র, তটরেখা, পাহাড়-এ সবই প্রকৃতির অঙ্গ। প্রতিটি অঞ্চলের নির্দিষ্ট ইকোসিস্টেম। প্রাণী, উদ্ভিদ ও মানুষের সমাবেশ। এদের সবাইকে নিয়েই বাস্তুসংস্থান বা ইকোলজি। প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের একটা নিগূঢ় সম্পর্ক আছে। সম্পর্কটি ভঙ্গুর, ভারসাম্য সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম। প্রকৃতির এই পারস্পরিক বিন্যাস সব অংশেই বিশেষ মাত্রার মধ্যে সীমাবদ্ধ।
ওজোন স্তরে ছিদ্র, গ্লোবাল ওয়ার্মিং, ক্লাইমেটিক চেঞ্জ এবং বায়োডাইভার্সিটির অবলুপ্তি এসব একসূত্রে বাঁধা। একইসূত্রে বাঁধা রয়েছে দারিদ্র্য, গরিব দেশগুলোর অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন, ধনী দেশগুলোর দ্বারা গরিব দেশগুলোর শোষণ এবং সভ্যতার অপব্যাখ্যা।
আমরা যেন প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা সম্পর্কে অধিকতর সচেতন হই।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন